ধানের ব্লাস্ট রোগ ও তার প্রতিকার

ধানের ব্লাস্ট রোগ ও তার প্রতিকার

ধানের ব্লাস্ট রোগ ধানের অন্যতম বিধ্বংসী রোগ হিসেবে পরিচিত, যা ধানের ফলনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং যদি সময়মতো প্রতিকার করা না যায় তবে ধান ক্ষেতের পুরো উৎপাদন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগটি মূলত ছত্রাক Magnaporthe oryzae দ্বারা সংঘটিত হয় এবং ধানের বিভিন্ন অংশে আক্রমণ করতে সক্ষম। এর বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ:

ব্লাস্ট রোগের ধরন

ধানের ব্লাস্ট রোগ তিনটি প্রধান অংশে আক্রমণ করে:

  1. পাতার ব্লাস্ট (Leaf Blast):

    • ধানের ছোট গাছের পাতায় প্রথমে হালকা সবুজ বা ধূসর রঙের হীরক আকৃতির দাগ দেখা যায়।
    • দাগগুলো পরবর্তীতে বড় হয়ে বাদামী বা ধূসর রঙের হয় এবং মাঝে ধূসর বা সাদা রঙের দাগ দেখা যায়।
    • পাতা আক্রমণ হলে ধানের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয় এবং চারা গাছগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে।
  2. গলার ব্লাস্ট (Neck Blast):

    • ধানের গলাতে আক্রমণ করে। শীষের গোড়ার অংশ কালো বা বাদামী রঙের হয়ে যায় এবং শীষগুলির সঠিকভাবে বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
    • গলার আক্রমণে ধানের দানা ঠিকমতো হয় না এবং শীষ শুকিয়ে যায়।
  3. শিষের ব্লাস্ট (Panicle Blast):

    • ধানের শীষে আক্রমণ করলে শীষের কিছু অংশ শুকিয়ে যায় এবং শীষের গায়ে সাদা বা ধূসর দাগ দেখা যায়।
    • এতে শীষের দানাগুলো খালি বা হালকা হয়ে যায়, ফলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।

রোগের বিস্তার

ধানের ব্লাস্ট রোগ বায়ু, পানি, এবং সংক্রমিত বীজের মাধ্যমে ছড়ায়। ছত্রাকের স্পোর বাতাসের মাধ্যমে অন্য গাছে পৌঁছে গিয়ে নতুন সংক্রমণের কারণ হতে পারে। বৃষ্টির সময়, বিশেষ করে মেঘলা ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ধানের ব্লাস্ট রোগের জন্য অনুকূল পরিবেশ:

  • আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়া: যখন তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে এবং বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে, তখন এই রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার বেশি দেখা যায়।
  • খারাপ পানি নিষ্কাশন: ধানের জমিতে পানি নিষ্কাশনের সমস্যা থাকলে রোগের প্রকোপ বেশি হয়।
  • উচ্চ নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ: অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে ধানের পাতার বৃদ্ধি বেশি হয়, যা রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে।

ব্লাস্ট রোগের প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনা

১. সাধারণ প্রতিরোধক ব্যবস্থা:

  • রোগ প্রতিরোধী জাত: ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধানের জাত নির্বাচন করা হলে রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের মতো ধান উৎপাদক দেশে BRRI Dhan 28, BRRI Dhan 29 ইত্যাদি জাতের ধান ব্লাস্ট প্রতিরোধী হিসেবে পরিচিত।
  • বীজ শোধন: বীজ শোধন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৫-৬ গ্রাম থিরাম বা ক্যাপটান জাতীয় ছত্রাকনাশক ১ কেজি বীজে প্রয়োগ করতে হবে। এতে ছত্রাকজনিত রোগের ঝুঁকি কমে যায়।

২. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ:

  • ট্রাইকোডার্মা (Trichoderma): ট্রাইকোডার্মা একটি ছত্রাক যা অন্যান্য ক্ষতিকর ছত্রাককে দমন করতে সক্ষম। এটি ধানের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
  • বেশি পরিমাণ জৈব সার ব্যবহার: সুষম জৈব সারের ব্যবহার ধানের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

৩. কৃষি ব্যবস্থাপনা:

  • পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ: আগের ফসলের খড়কুটো জমি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, কারণ এই খড়কুটোর মাধ্যমে ছত্রাকটি জমিতে থেকে যেতে পারে।
  • জমিতে পর্যাপ্ত রোদ পৌঁছানোর জন্য জমির পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গাছের মধ্যে যথেষ্ট জায়গা রাখা: ধানের চারা যথেষ্ট দূরত্বে রোপণ করতে হবে যাতে গাছে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল হয়।

৪. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ:

  • ছত্রাকনাশক প্রয়োগ:
    • ধানের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি ছত্রাকনাশক ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ট্রাইসাইক্লাজোল (Tricyclazole) এবং আইসোপ্রোথিওলান (Isoprothiolane) উল্লেখযোগ্য।
    • ধানের বীজতলায় অথবা ৩০-৪০ দিনের পর প্রতি লিটার পানিতে ১-২ গ্রাম ট্রাইসাইক্লাজোল মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
    • ফুল আসার পূর্বে আইসোপ্রোথিওলান বা অ্যাজোক্সিস্ট্রোবিন (Azoxystrobin) জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা দরকার।

ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সঠিক সময়:

  • ব্লাস্ট রোগের প্রথম লক্ষণ দেখার সাথে সাথেই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • গলার ব্লাস্ট হলে দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, বিশেষত ধান ফুল আসার পূর্বে।
  • স্প্রে করার সময় চারা গাছগুলোতে সমভাবে ছত্রাকনাশক ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে প্রতিটি গাছে সঠিকভাবে ছত্রাকনাশক পৌঁছায়।

৫. সারের ব্যবহার এবং পানি নিয়ন্ত্রণ:

  • সুষম সারের ব্যবহার: নাইট্রোজেন সার বেশি ব্যবহার করলে ধানের ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। তাই সুষম সারের প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষত নাইট্রোজেন কমাতে হবে।
  • পানি ব্যবস্থাপনা: ধান ক্ষেতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি থাকতে হবে। কিন্তু পানি যাতে স্থির না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ক্ষেতের জমি ভালোভাবে শুকাতে হবে।

ব্লাস্ট রোগ ব্যবস্থাপনার আধুনিক প্রযুক্তি:

  • ড্রোনের মাধ্যমে স্প্রে: বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ড্রোন ব্যবহার করে বিশাল ধানের মাঠে সমানভাবে ছত্রাকনাশক ছিটানো হচ্ছে।
  • রোগ সনাক্তকরণ অ্যাপ: কিছু দেশে ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক সনাক্তকরণের জন্য মোবাইল অ্যাপের ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। এসব অ্যাপের মাধ্যমে চাষিরা দ্রুত এবং সঠিকভাবে রোগ চিহ্নিত করতে পারেন।

সঠিক সময়ে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ব্লাস্ট রোগের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ধানের ফসলকে বাঁচানো সম্ভব।

Post a Comment

Previous Post Next Post