কবুতরের ম্যালেরিয়া রোগ (Pigeon Malaria) ( সংগ্রহ )





আমাদের খামারে কোন কবুতর যখনি অসুস্থ হয় তখনি আমরা কোন না কোন ঔষধ প্রয়োগ করি। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত ঔষধ নির্বাচন সঠিক হয়। তাও সেগুলো বেশির ভাগই অনুমানের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা জানি না কোন রোগের জন্য আমরা এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছে। আর কোন রোগের জন্য কোন ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। আর কতদিন এই সব ঔষধ প্রয়োগ করতে হয় তা ৯৫% খামারিরাই জানেন না। এমনকি আমাদের দেশের অধিকাংশ পশু ডাক্তাররাও অনেক রোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না বা এই ধরনের রোগের ক্ষেত্রে কি ধরনের ঔষধ প্রয়োগ করা উচিৎ সে সম্পর্কে নিজেকে প্রস্তুত করতেও প্রস্তুত না উনারা। আর এর ফল ভোগ করেন নিরীহ খামারিরা। তাই আপনাকে আগে রোগের সঠিক ধরন তা জানতে হবে চিকিৎসা শুরু করার আগে। তাহলেই কেবল আপনার পরিশ্রম সার্থক হবে। না হলে সব কিছুই ভেস্তে যাবে কোন সন্দেহ নাই।

কবুতরের ম্যালেরিয়াঃ
================
Plasmodiosis বা ম্যালেরিয়া ধিরে ধিরে দৃশ্যমান হয়ে উঠা একটি অতি জঘন্য ধরনের প্রচলিত রোগ। যাকে তথাকথিত নদীর রোগও বলা হয়। এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক সময়ই কোন লক্ষণ প্রকাশ পাই না। কিন্তু একটু ভাল করে খেয়াল করলেই লক্ষণ গুলো ধরা পরে। এটি পোকামাকড় দ্বারা সৃষ্ট পৃথিবীতে প্রচুর পাখি ও কবুতরের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়।

কারনঃ
=====
১) এটি কবুতরের গায়ের রক্ত শোষক মাছি যার নাম জকি বলা হয় (যদিও অনেক পশু ডাক্তার মনে করেন সাধারন মাছি এই রোগের কারণ কিন্তু আসলে তা সঠিক না।) ও স্ত্রি মশা যাকে আনোফেলিস বলা হয়। এই দুটি প্রাথমিক বাহক হিসাবে কাজ করে থাকে। যা পরে অন্তর্বর্তী হোস্ট হিসাবে কাজ করে। যারা প্রটোজোয়ান নামক জীবাণু কবুতরের শরীরে অনুপ্রবেশ ঘটায়। যার ফলে এই জীবাণু কবুতরের লাল রক্ত কোষে আক্রমন করে এটিকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে কবুতরে করুন মৃত্যু ঘটে।
২) বাইরের পাখি বা কবুতর এই রোগের বাহক হিসাবেও অনেক সময় কাজ করে থাকে।
৩) আক্রান্ত কবুতর বা পাখি থেকে অন্য কবুতরের মধ্যে সংক্রমিত হতে দেখা যায়।
৪) আক্রান্ত পাখি বা কবুতরের মল বা বিষ্ঠা থেকে এই রোগ সংক্রমিত হয়।
৫) মশা উৎপন্ন হয় যেখানে এ রকম আবহাওয়া বৈশিষ্ট্য স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের কারনেও হতে পারে।

লক্ষণঃ
====
১) মুখ হাঁ করে শ্বাস নিবে কিন্তু মুখের ভিতরে কোন কফ বা সাদা ধরনের কিছু থাকবে না। (যদিও অনেকেই এটাকে ডিপথেরিয়ার লক্ষণ বলেও ভুল করে থাকে।)
২) বুকের নিচে পাতলা হাড্ডির কাছে লোম শূন্য ও প্রচুর খুস্কি দেখা যাবে। (যদিও অনেক সময় সুস্থ কবুতর অনেক দিন গোসল না করার ফলেও এ ধরনের খুস্কি দেখা যেতে পারে।)
৩) পালকের উজ্জলতা বা মসৃণ বা তেলতেলে ভাবতা নষ্ট হয়ে যাবে।
৪) কবুতর কে ধরলেই সেটা সাদা সাদা ধরনের বমি করবে ও প্রচণ্ড হাঁপাবে। ও মুখের ভিতরে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ থাকবে যা অনেক সময় দূর থেকেই পাওয়া যায়। (যদিও ডিপথেরিয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের লক্ষণ দেখা যাই।) যদিও কিছু খেলেও বমি করার প্রবনতা থেক্তে পারে।
৫) ফ্যাঁকাসে ও সাদা ঠোঁট দেখা যাবে। (সুস্থ কবুতরের মত গোলাপি ধরনের ঠোঁট থাকবে না)
৬) কবুতরের মধ্যে উদ্যমতা থাকবে না উদাসীনতা প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ হটাত করে চমকে উঠবে।
৭) গায়ের তাপমাত্রা বেশী হবে স্বাভাবিকের থেকেও ও একটানা জ্বর থাকবে গায়ে।
৮) রক্তাল্পতা প্রকাশ পাবে।
৯) কবুতর খুবই খুব দুর্বল হয়ে পড়বে অল্পদিনের মধেই ও টলে পড়ে যাবে।
১০) পায়খানার তেমন কোন বিশেষ লক্ষণ চোখে পড়বে না, তবে পাতলা হলুদ বা সাদা ও সবুজ মিক্স ধরনের থাকবে। অথবা সাদা জমাট আঠাল ধরনের হতে পারে।
১১) এই রোগ সাধারণত বাচ্চা অর্থাৎ ইয়ং কবুতর ও ডিম পাড়া মাদী কবুতর বেশী এক্রান্ত হতে দেখা যায়।
১২) পাখা ঝুলে যাবে ও লেজ নেমে থাকবে।
১৩) এই রোগে কবুতরের লিভার অনেক বড় হয়ে যাই, আর রক্ত কোষের সংখ্যা কমে যাবার ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই কবুতরের মৃত্যু ঘটবে।

প্রতিরোধঃ
=======
যেহেতু এই রোগে একবার আক্রান্ত হলে সেই কবুতর ম্যালেরিয়ার জীবাণু আজীবন বহন করে। তাই এই রোগের প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ করাটাই ভাল।
১) আপনার খামারে যেন পানি না জমে বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেখানে মশা ডিম উৎপাদন করতে না পারে।
২) বাইরের পাখি বা কবুতর যে খামারে প্রবেশের সুযোগ না পায় তার যথাযথ ব্যাবস্থা নিতে হবে।
৩) কবুতরের গায়ে যেন মাছি না জন্মে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে, এ জন্য তাদের গোসল করার ব্যাবস্থা করা বা নিজে ধরে গোসল করাতে হবে।
৪) অন্য কবুতরের সঙ্গে মিশলে সেই কবুতর গুলোকে ভাল করে ধুলো মুক্ত করা বা জীবাণু মুক্ত করা। যাতে খামারে জীবাণু প্রবেশ না করে।
৫) নিয়মিত জীবাণু মুক্ত স্প্রে করা।
৬) খামার নিয়মিত পরিস্কার পরিছন্ন রাখা।
৭) হোমিও Eupatorium perfo 30 ১ সিসি ১ লিটার পানিতে মিক্স করে মাসে একবার করে দিলে প্রতিরোধের জন্য ভাল উপকার পাওয়া যায়।
৮) রসুন পানি মাসে একবার অন্তত পরিবেশন করুন। ২ চামচ রসুন বাঁটা ১ কাপ পানিতে মিক্স করে ছেকে ১ লিটার পানিতে মিক্স করে দিন।
৯) অ্যাপেল সিডার মাসে অন্তত একবার পরিবেশন করুন ১ সিসি ১ লিটার পানিতে।

প্রতিকার/ চিকিৎসাঃ
===============
১) এই রোগের চিকিৎসা একটু ধৈর্যশীলতা পরিচয় দিতে হয়। কারণ রোগ চিকিৎসা ৫২ দিন পর্যন্ত চালাতে হয় লাল রক্ত কোষ গুলো আবার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে।
২) রোগ ভাল হবার পরও সপ্তাহে বা মাসে ১-২ দিন এই চিকিৎসা চালাতে হতে পারে।
৩) আয়রন ও জিঙ্ক ভিটামিন দিতে হবে যাতে লাল রক্ত কোষ বাড়তে সাহায্য হয়।
৪) ১/৪ ভাগ AVLOQUIN (Chloroquine phosphate) + ১/৪ ভাগ JASOPRIM (primaquine) + ১ গ্রাম গ্লুকোজ+ ১ স্যালাইন =১০ সিসি পানিতে মিক্স করে দিনে ৩ বার করে দিতে হবে।
৫) চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে যেন কোন ভিটামিন ও মিনারেলস বাদ না পরে যথাবিধি সেগুলোকে প্রয়োগ করতে হবে।
৬) তবে সব থেকে কার্যকরী ঔষধ হল ARALEN WS Tablet (imported) প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
ময়না তদন্তঃ যদি আপনি কবুতরে কে ব্যাবচ্ছেদ করেন তাহলে দেখবেন ওর লিভারের গায়ে অনেক ছোট ছোট কাল ফোঁটা ফোঁটার মত জমাট রক্তর মত হয়ে আছে ও হালকা কালচে বরন ধারন করেছে।
আর সর্বোপরি মনে রাখতে হবে যে, আপনি যদি রোগ নির্ণয়ে অসুবিধা হয় তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ সাহায্য নিতে হবে, বিশেষ করে এই রোগ নির্ণয় করা বেশ কঠিন; কারণ এই ম্যালেরিয়ার লক্ষণ অন্যান্য রোগের লক্ষণের অনুরূপ হয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post