টমেটো
(Solanum lycopersicum) একটি
জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর সবজি
যা প্রায় সকল বাড়ির বাগানে
চাষ করা হয়। এটি
সঠিকভাবে চাষ করলে ভালো
ফলন পাওয়া সম্ভব। নিচে টমেটোর চারা
রোপণ ও পরিচর্যা সম্পর্কে
বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো:
১. টমেটো চাষের জন্য জমি নির্বাচন
- মাটির
ধরন: টমেটো গাছের জন্য উর্বর, ভালভাবে পানি নিষ্কাশন
হতে পারে এমন মাটি প্রয়োজন। সাধারণত দো-আঁশ মাটি ভালো। মাটির pH ৬-৬.৮ এর মধ্যে হওয়া উচিত।
- জমির
অবস্থান: এমন জায়গায় টমেটো চাষ করুন যেখানে গাছ পর্যাপ্ত
রোদ পায়। টমেটো গাছ দিনে কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো পেলে সেরা ফলন পাওয়া যায়।
- পানি
নিষ্কাশন: টমেটো গাছের শিকড় অনেক গভীরে যেতে পারে, তাই জমিতে পানি জমে না যেতে হবে। সেচের ব্যবস্থা
ভালো রাখতে হবে, যেমন জমির নিচে ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২. বীজ বাছাই ও চারা তৈরি
- বীজ
নির্বাচন: যদি আপনি ভালো ফলন চান, তবে বীজ নির্বাচনে
খুব সতর্ক থাকতে হবে। বীজটি অবশ্যই ভালো জাতের হওয়া উচিত এবং রোগবালাই মুক্ত হওয়া উচিত। স্বতঃসিদ্ধ এবং স্থানীয়ভাবে ভালো ফলন দেওয়া জাত যেমন "লাক্স" বা "বিঙ্গো" বেশ জনপ্রিয়।
- বীজ
বপন: বীজ বপন করার জন্য প্রথমে একটি বীজ বপনের বাক্স বা পট নির্বাচন
করুন। মাটির গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য সেখানে হালকা সার (যেমন পচা গোবর বা কম্পোস্ট) মিশিয়ে দিন। বীজগুলো প্রায় ১-২ সেন্টিমিটার গভীরে রাখুন। সাধারণত, ১ বর্গফুট জায়গায় ১০০-১৫০টি বীজ বপন করা যায়।
- বীজের অঙ্কুরোদগম: ৭-১০ দিনের মধ্যে বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়ে চারা গাছ হয়ে ওঠে। এতে যদি মাটি খুব শক্ত হয়, তবে চারা বের হতে সময় নিতে পারে। বীজের অঙ্কুরোদ্গম হলে চারা গাছকে একটু একটু করে সূর্যের আলো দেওয়ার চেষ্টা করুন, যাতে চারা শক্তিশালী হতে পারে।
৩. চারার স্থানান্তর বা রোপণ
- চারার
বয়স: সাধারণত ৪-৫ সপ্তাহ বয়সী চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়। যখন চারা প্রায় ৬
ইঞ্চি বা তার বেশি লম্বা হয়ে যায় এবং একাধিক পাতা বের হয়ে আসে, তখন এটি রোপণ করা যেতে পারে।
- রোপণের
সময়: বসন্ত বা শীতের শেষ দিকে (মধ্য ফেব্রুয়ারি
থেকে মার্চ) টমেটো গাছ রোপণ করতে হয়। তবে, এর জন্য একটি ভালো সময় নির্ধারণ করে নিতে হবে। অনেক গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে মে-জুন মাসেও চাষ করা যায়।
চারার রোপণ:
- প্রতিটি গর্তে চারা রোপণ করুন, গর্তের গভীরতা প্রায় ৮-১০ ইঞ্চি হওয়া উচিত।
- প্রতিটি গর্তে ১টি করে চারা রোপণ করুন এবং চারপাশে মাটি শক্তভাবে
চাপ দিন।
- রোপণ করার পর ভালোভাবে
পানি দিন, যাতে মাটি আর্দ্র থাকে এবং গাছ শক্তভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
৪. পানি দেওয়া
- টমেটো গাছের প্রচুর পানি প্রয়োজন।
তবে, অতিরিক্ত পানি জমে থাকা থেকে বিরত থাকতে হবে। অল্প অল্প করে নিয়মিত পানি দিতে হবে।
- টমেটো গাছের জন্য আদর্শ সেচ ব্যবস্থা
হলো ড্রিপ সেচ, যা মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং গাছের শিকড়ের কাছে পানি সরবরাহ করে।
- পানিসেচের
সময় সন্ধ্যা বা ভোর বেলায় পানি দেওয়া উত্তম, দুপুরে পানি দেওয়ার ফলে গাছ পুড়ে যেতে পারে।
222
৫. সার প্রয়োগ
টমেটো
গাছের
বৃদ্ধির জন্য
পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রয়োজন। সার
প্রয়োগের কয়েকটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক:
সারের ধরন:
- শুরুতে
(জন্মের সময়): গাছের শিকড় দ্রুত বাড়ানোর জন্য ভালো পরিমাণে নাইট্রোজেন
(যেমন ইউরিয়া) সার দরকার। তবে বেশি নাইট্রোজেন দিলে শুধু পাতা বাড়বে, ফুল বা ফল কম আসবে।
- ফুল
আসার পর: ফুল আসার পর পটাশিয়াম
এবং ফসফরাস সারের চাহিদা বাড়ে, কারণ এটি ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- জৈব
সার: গোবর বা কম্পোস্ট
সার ব্যবহার করা হলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এছাড়া, মাটি আর্দ্র রাখা যায় এবং এর সাথে মাটির মাইক্রো-অর্গানিজমের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়।
সারের প্রয়োগ পদ্ধতি:
- সারের প্রয়োগ অবশ্যই মাটির অবস্থা এবং গাছের অবস্থার ওপর নির্ভর করে হতে হবে। সার প্রয়োগের
সময় গাছের বয়স, অবস্থান এবং মাটির পুষ্টির মাত্রা লক্ষ্য রাখতে হবে।
৬. গাছের পরিচর্যা
টমেটো গাছের স্ট্যাকিং:
- টমেটো গাছ অত্যন্ত ভারী হতে পারে, বিশেষত ফল হওয়ার সময়। সেক্ষেত্রে
স্ট্যাকিং বা সাপোর্ট দেওয়া জরুরি। গাছের ট্রাঙ্কের পাশে একটি মজবুত কাঠের বা ধাতব স্ট্যাক ব্যবহার করুন।
- এছাড়া, টমেটো গাছের কিছু শাখা ছেঁটে দিয়ে (প্রিন্সিং)
গাছের শক্তি ভেঙে যাওয়ার থেকে রোধ করতে পারবেন।
এগাছের ছাঁটাই:
- একে "সিঙ্গল স্টেম" বা "ইনডিটারমিনেট"
প্রকার হিসেবে চাষ করা হলে, গাছের অতিরিক্ত শাখা বা অপ্রয়োজনীয় শাখা ছেঁটে দিতে হবে যাতে ফলন বৃদ্ধি পায়। এটি সঠিকভাবে ছাঁটাই করতে পারলে, গাছ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং ফলন ভালো হবে।
৭. রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধ
টমেটো
গাছের
মধ্যে
বিভিন্ন রোগ
এবং
পোকামাকড়ের আক্রমণ
হতে
পারে।
এগুলো
প্রতিরোধের জন্য
কিছু
ব্যবস্থা নেওয়া
যেতে
পারে।
রোগসমূহ:
- পাউডারি
মিলডিউ: এটি ফাঙ্গাসের
কারণে হয়ে থাকে। প্রতিরোধের জন্য সারের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, এবং নির্দিষ্ট সময়ে সালফার বা কপার সলিউশন স্প্রে করতে হবে।
- ফসলের
ভাইরাস: টমেটো গাছের মধ্যে অনেক ধরনের ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। ভাইরাস প্রতিরোধে,
ভাইরাসমুক্ত বীজ ব্যবহার করা এবং সঠিকভাবে সেচ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
পোকামাকড়:
- টমেটো গাছের উপর বিভিন্ন পোকা আক্রমণ করতে পারে, যেমন অ্যাফিড, টমেটো হর্নওয়ার্ম
এবং শূককীট। এগুলো প্রতিরোধ করতে প্রতিরোধক স্প্রে (নিম অয়েল বা পেস্টিসাইড) ব্যবহার করা যেতে পারে।
333
৮. ফল সংগ্রহ
টমেটো
গাছের
ফল
সাধারণত ফুল
থেকে
৫০-৮০ দিনের মধ্যে
পাকে।
তবে,
কিছু
জাত
দ্রুত
ফল
দেয়।
- ফল
পাকার সময়: টমেটো যখন সম্পূর্ণভাবে
রঙ পরিবর্তন করে (লাল, হলুদ বা অন্যান্য রঙের টমেটো জাত অনুসারে) এবং শক্ত হয়, তখন ফল সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত।
- ফল
কাটার সময়: ফল কাটার সময় হাত দিয়ে হালকাভাবে
টান দিলে, গাছের শাখা ভেঙে যাবে না। এছাড়া, গাছের ফল না হলে তবে ফল সংগ্রহ করার জন্য একটু ঝুঁকিও কম হয়।
উপসংহার:
সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে এবং
নিয়মিত পরিচর্যা দিলে টমেটো গাছ
থেকে ভালো ফলন পাওয়া
যায়। সর্বোপরি, যেকোনো ফসলের সফলতার জন্য মাটির সঠিক
পরিচর্যা, নিয়মিত পানি, উপযুক্ত সার এবং পর্যাপ্ত
রোদ্র প্রয়োজন।
إرسال تعليق